ن: وَالْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ مَا أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍ (سورة القلم)
[বাংলা অনুবাদ]
“নূন – শপথ কলমের এবং যা কিছু তারা লিখে! আপনি আপনার প্রভুর অনুগ্রহে উন্মাদ নন। আর আপনার জন্য অবশ্যই রয়েছে এক অশেষ পুরস্কার।” (সূরা ক্বলম)
[প্রাসঙ্গিক কথা]
পবিত্র কালামে পাকের ২৯তম পারায় অবস্থিত সূরা নূন বা কলম, যা ৬৮ নম্বর সূরা হিসেবে পরিচিত—একটি মহান ও গভীর তাৎপর্যময় সূরা। এর শুরুতেই আল্লাহ তায়ালা ‘নূন’ ও ‘কলম’-এর শপথ করেছেন। এই ‘কলম’ দ্বারা সম্ভবত সাধারণ কলমের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জ্ঞানী, লেখক ও আলেমগণ ধর্মীয়, পার্থিব কল্যাণ ও হেদায়েতি বার্তা লিপিবদ্ধ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে সেই উচ্চ মর্যাদার ‘নূরী কলম’-এর প্রতি, যার দৈর্ঘ্য আসমান ও জমীনের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। আল্লাহর নির্দেশে এই মহান কলম ‘লাওহে মাহফূজে’ কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিত সব ঘটনা ও তাকদীর লিপিবদ্ধ করে।
এই আয়াতগুলোতে পরম করুণাময় হুজুর নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা, মর্যাদা ও শান তুলে ধরা হয়েছে, এবং তাঁর প্রতি অবমাননাকারীদের যুক্তিপূর্ণভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। সূরাটির প্রতিটি আয়াতে যেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলি ও মর্যাদার প্রশস্তি ফুটে উঠেছে—তাঁর সুমহান চরিত্র ও নবুওয়তের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বর্ণে-বাক্যে।
তবে সূরাটির গভীরতা ও অর্থ ঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় ও পটভূমি জানা আবশ্যক।
১.বর্ণিত আয়াতসমূহের অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট।
২.’নুন’ এবং ‘কলম’ দ্বারা কি মর্মার্থ।
৩.বর্ণিত আয়াতে পাকে কয় ধরনের প্রশংসা নিঃসৃত হয়েছে।
[১. অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট]:
মক্কা নগরীর কাফের ও মুশরিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল এক কুখ্যাত দুশমন—রাসূলপ্রেম বিরোধী, নবী বিদ্বেষী ‘ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা’। সে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বিশ্বজগতের জন্য রহমত, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-কে (সা.) “মাজনুন” — অর্থাৎ উন্মাদ বলে কটাক্ষ করত। সে কুরআনের এই আয়াতটি উচ্চারণ করে অপমান করেছিল:
يَا أَيُّهَا ٱلَّذِى نُزِّلَ عَلَيْهِ ٱلذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُونٌ
— “হে সেই ব্যক্তি, যার ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! নিশ্চয়ই তুমি উন্মাদ।” (সূরা আল-হিজর: ৬)
এই কটুবাক্য প্রিয় নবীজির (সা.) পবিত্র অন্তরকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। তাঁর দুঃখে আকাশ পর্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়েছিল। তখন, দয়াময় আল্লাহ্—রব্বুল আ’লামিন স্বয়ং, তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মর্যাদা, পবিত্রতা ও সত্যতা প্রতিষ্ঠা করে অপপ্রচারকারীদের অপমানজনক চরিত্র উন্মোচন করলেন। যেন নবীজির হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে।
إِنَّهُ قَسَمٌ: ن ۚ وَٱلْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ، مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ — “নূন! শপথ কলমের এবং যা কিছু তারা লিখে, হে আমার প্রিয়, আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে উন্মাদ নন।” (সূরা আল-কালম: ১-২)
এই মহান আয়াতে, আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিব (সা.)-এর পক্ষ নিয়ে সেই সকল কুটুক্তিকারীকে চিহ্নিত করলেন, যারা ছিল বদজাত, মিথ্যাবাদী, চোগলখোর, অপবিত্র অন্তরের অধিকারী, এবং নৈতিকভাবে ঘৃণিত। (তাফসীর: সফওয়াতুত তাফাসীর, ৩য় খণ্ড; তাফসীরে সাভী, ৪র্থ খণ্ড)
[২. ‘নুন’ শব্দটির মর্মার্থ]:
এটি সেই সূরারই একটি পবিত্র নাম হতে পারে, কিংবা মহান আল্লাহ তায়ালার কোনো গৌরবময় নাম—যেমনটি উল্লেখ করেছেন সাভী ও মোয়াল্লিমুত তানজীল। আবার কারো মতে, এটি আমাদের প্রিয় নবী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মোবারক নাম। অন্যদের মতে, ‘ن’ (নুন) অক্ষরটি ‘নূর’ ও ‘নাছের’-এর প্রথম অক্ষর, যা মিলিতভাবে আল্লাহ তায়ালার পবিত্র নামের দিকেই ইঙ্গিত করে। কেউ কেউ বলেন, ‘নুন’ মানে হচ্ছে ‘নূর’-এর সূচনা—আর এই ‘নূর’ হলো হুজুরে আকরাম (দ.)-এরই পবিত্র নাম।
আল্লাহর বাণীতে, সূরা আল-মায়েদায় ইরশাদ হয়েছে—(قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌۭ وَكِتَـٰبٌۭ مُّبِينٌۭ)
—অর্থাৎ, ‘তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নূর এবং এক স্পষ্ট কিতাব।’ (সূরা আল-মায়েদা)
এখানে ‘নুন’ শব্দের অর্থে বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে। এক অর্থে, ‘নুন’ দ্বারা হুজুর (দ.) এর শপথ বুঝানো হয়েছে। অন্য অর্থে, ‘নুন’ হলো আল্লাহ তায়ালার নামসমূহের মধ্যে একটি অংশ, যেখানে الر ـ حم ـ ن মিলিত হয়ে ‘রাহমান’ শব্দটি গঠিত হয়। তাই এশপথে রব তায়ালা তাঁর নিজস্ব অস্তিত্বের শপথ নিয়েছেন।
আরেকটি ব্যাখ্যায় ‘নুন’ শব্দের অর্থ মাছ, যা আরবি ভাষায় মাছকে ‘নুন’ বলা হয়। এই অর্থে, এখানে সেই মাছের ইঙ্গিত, যার পেটে নবী ইউনূস (আ.) ছিলেন। আবার কেউ কেউ এটিকে সেই মাছ বলেও মনে করেন, যা জান্নাতীদের প্রথম খাদ্য হবে। অথবা এই মাছটিকে বুঝানো হয়েছে যার উপর পৃথিবীর অবস্থান নির্ভরশীল। (রুহুল বয়ান, তাফসীরে আজিজী, কুরতুবী, সাভী)
‘কলম’ বলতে এখানে সাধারণ কলমই বোঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে জ্ঞান ও ইলম লিখা হয়। এই কারণেই কলমের একটি বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং এর প্রতি শপথ গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ‘কলম’ বলতে সেই ঐতিহাসিক কলমটিকেও বুঝানো হতে পারে, যার দ্বারা লওহে মাহফুজে সব ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে (যেমন ‘খাযাইনুল ক্বোরআন’-এ বর্ণিত)।
কখনো কখনো কলম বলতে ফেরেশতাদের সেই কলমকে বোঝানো হয়, যার দ্বারা তারা মায়ের গর্ভে সন্তানের তাকদীর লিখে রাখে। আবার একই কলমের মাধ্যমে ফেরেশতারা মানুষের আমলনামাও লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ সকল অর্থেই এখানে ‘কলম’ শব্দের গভীরতা নিহিত।
তবে এসব অর্থের মধ্যে সরাসরি সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। এজন্য অনেক মুফাস্সির মতে, এখানে ‘কলম’ দ্বারা প্রায়ই হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নামই নির্দেশিত হতে পারে। যেমন একটি হাদীসে এসেছে— “أول ما خلق الله القلم”
অর্থাৎ, ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন।’
আবার অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে— “أول ما خلق الله نوري”
অর্থাৎ, ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার মোবারক নূর সৃষ্টি করেছেন।’
এইভাবেই ‘কলম’ শব্দের গভীরতা এবং এর আলোকিত অর্থ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
এখানে দুটি হাদীস শরীফ এমনভাবে একত্রিত করা হয়েছে, যেন “নূন” ও “কলম”—এই দুই অনন্য আলামতের মাধ্যমেই হাকীকতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গভীরতম রূপ উন্মোচিত হয়েছে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব, হুজুর ছাহেবে লাওলাক (দ.) কে “কলম” বলা হয় এ কারণে যে, যেমন লিখনের পূর্বে কলমের অস্তিত্ব থাকে, তেমনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের সূচনার আগেই তাঁর অস্তিত্ব ছিল। আবার যেমন কেউ কলমে লিপিবদ্ধ আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করতে পারে না, তেমনি প্রিয় নবীর (দ.) বিধানও অপরিবর্তনীয়—তাঁর কথাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তাঁর আদেশই বিশ্বজগতের জন্য বিধান। বস্তুতঃ তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার ‘কলম’—সৃষ্টি ও শাশ্বত সত্যের বাহক।
অন্য এক বিশ্লেষণে বলা হয়, এখানে “নূন” দ্বারা বোঝানো হয়েছে রাসূলে পাক (দ.)-এর পবিত্র ওষ্ঠ মোবারক এবং “কলম” দ্বারা তাঁর জবান মোবারক। যেমন কলম দোয়াতের সাহায্যে লিখে, তেমনি প্রিয় নবী (দ.)-এর পবিত্র বাক্য প্রকাশ পায় আল্লাহপ্রদত্ত ওষ্ঠ ও জিহবার মাধ্যমে। জবান থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও ওষ্ঠ মোবারক থেকে নির্গত প্রতিটি অক্ষরই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন— وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ (সূরা নজম)
“তিনি মনগড়া কিছু বলেন না; এটি তো এক বিশুদ্ধ ওহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।”
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানুষের ওষ্ঠ, জিহ্বা এবং দোয়াত—এই তিনটির বাহ্যিক গঠনে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য বিরাজমান। অতএব, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর জবান মোবারক হলো আল্লাহর দোয়াত, তাঁর ওষ্ঠ মোবারক হলো স্রষ্টার কলম, আর তাঁর বাণী হলো রব্বুল আলামীনেরই ফরমান।
পরিশেষে, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন— “وَمَا يَسْطُرُونَ”
“শপথ সেই বিষয়ের, যা কলম লিপিবদ্ধ করে।”
এখানেও রয়েছে বিভিন্ন অভিমত।
কারও মতে, এখানে তাঁদের কথাই বোঝানো হয়েছে—যাঁরা দ্বীনের জ্ঞানে নিজেকে নিবেদিত করে তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন। অর্থাৎ, হে আমার প্রিয়তম! আমি শপথ করছি আপনার পবিত্র জবান ও ঐ মহিমান্বিত বাণীগুলোর, যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ লিখবে ও পড়বে—শত শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও যেগুলোর দীপ্তি ম্লান হবে না।
আসলে, এই পবিত্র বাণীগুলির প্রতি জীবন উৎসর্গ করাও অনুচিত নয়। দুনিয়ার বাদশাহরা নিজেদের নাম স্বর্ণ ও রূপায় খোদাই করে গেছেন, কিন্তু তা সময়ের স্রোতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ, সেই মহাসম্রাটের কথা কল্পনা করুন—যিনি মরুর বুকে কিছু সত্যনির্ভর, মোহনীয় শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। সেই বাণীগুলোকে সময়ের ঝড়, প্রকৃতির প্রলয় কিংবা বস্তুবাদী শক্তি—কোনো কিছুই মুছে ফেলতে পারেনি, পরিবর্তন করতে পারেনি। বরং তাঁর পবিত্র নাম, বাণী ও কর্ম আজও খোদাই হয়ে আছে সৃষ্টির ইতিহাসে, মানুষের হৃদয়ে, সাহিফার পাতায়, এমনকি নীরব পাথরের গায়ে। তা মুছে যায়নি, আর কখনো মুছে যাবে না।
কবির ভাষায়—
“মিটতে হে, মিট জায়েঙ্গে আ’দা তেরা,
না মিটা হ্যায়, না মিটেগা কব্হী ছরছা তেরা।”
অন্যদিকে, “ওয়ামা ইয়াসতুরূন”—এই আয়াতের মাধ্যমে অনেকেই ফেরেশতাগণের লিপিবদ্ধ করাকেই বুঝিয়েছেন। কারণ, তারা প্রিয় নবীজীর (সা.) পবিত্র বাণী ও মহৎ আমলসমূহ লিখে রাখেন। সারাংশে, উপরোক্ত তিনটি ব্যাখ্যাই আমাদের নবীজী হুজুর (সা.)-এর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও প্রশংসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর সম্মান ও স্মৃতি শুধু কিতাবে নয়, বরং বিশ্বচরাচরের প্রতিটি কণায় অনন্তকাল পর্যন্ত গাঁথা থাকবে।
এরপর মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—
“ما أنتَ بنعمةِ ربِّكَ بمجنونٍ.”
“হে প্রিয় নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের বিশেষ অনুগ্রহে কোনোভাবেই ‘মজনুন’ নন।”
এখানে ‘মজনুন’ শব্দটির অর্থ হতে পারে ‘উন্মাদ’, ‘পাগল’ অথবা ‘গোপন/অদৃশ্য’। প্রথম অর্থটি— ‘উন্মাদ’— সম্পূর্ণরূপে খণ্ডনযোগ্য, কেননা নবীগণের জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা গোটা সৃষ্টির তুলনায় অনেক উচ্চতর। আর সেই নবীদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ আকল ও কল্পনার আধার হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
ভেবে দেখুন, যদি কোনো বাদশাহর উজির পাগল হয়ে যায়, তাহলে পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোই ভেঙে পড়বে। তবে কি করে সম্ভব যে, সমস্ত সৃষ্টি যার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তিনি উন্মাদ হবেন? না, কখনোই না। কারণ প্রিয় নবী (সা.) এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর সাথে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কথা বলেন, ফেরেশতাগণ যাঁকে সালাম জানান, মানুষ ও জ্বিন সবাই তাঁর দরবারে নিজেদের আরজি পেশ করে।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী, এমনকি গাছপালা ও পাথরও তাঁর বার্তায় সাড়া দেয়। তিনি জমিনবাসীর প্রার্থনার উত্তরদাতা, আরশবাসীর আশার কেন্দ্রবিন্দু। সৃষ্টি তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী, আর স্রষ্টার দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিবদ্ধ। তিনিই সেই মহামানব, যিনি স্রষ্টার রহমত সৃষ্টির মাঝে পৌঁছে দেন, আবার সৃষ্টির চাহিদা ও অভাব স্রষ্টার দরবারে পৌঁছে দেন।
এত বিশাল দায়িত্ব ও মহান আমানত যার উপর অর্পিত, তিনি কি করে ‘মজনুন’ বা উন্মাদ হতে পারেন?
আর যদি ‘মজনুন’ অর্থে ‘মাস্তুর’ বা ‘গোপন’ বোঝানো হয়, তাহলেও অর্থ হবে: “হে আমার মাহবুব! আপনি লুকায়িত নন।”
আপনার কাছ থেকে কোন গায়েবের খবর, অতীত-ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা, সৃষ্টির কোনো চমক, কিছুই গোপন নয়। আপনি এমন এক নবী, যাঁর পরিচয় গোপন নয়— মুসলমান আপনাকে জানে, কাফির আপনাকে চিনে। এমনকি সূর্য, চাঁদ, বৃক্ষলতা, পাথর, আরশ-ফেরেশতাও আপনাকে চেনে ও মানে।
এরপর আরেকটি অপার আশ্বাস— “وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍ.”
“আর অবশ্যই আপনার জন্য রয়েছে এমন এক পুরস্কার, যার কখনো শেষ নেই।”
এই আয়াতে ‘আজর’ (পুরস্কার) এবং ‘মামনুন’ (সমাপ্তিহীন) শব্দ দুটিতে নিহিত রয়েছে অসংখ্য তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও অপার দয়া।
প্রথমতঃ— ‘আজর’ শব্দের একটি অর্থ হলো শাফায়াত (সুপারিশ) এবং ‘মামনুন’ শব্দের একটি অর্থ সমাপ্তি বা শেষ। এই অর্থে কুরআনের আয়াতটি ইঙ্গিত করছে— হে প্রিয় নবী (সাঃ)! আপনার শাফায়াত কখনোই শেষ হবে না। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শেষদিন পর্যন্ত, সমস্ত বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশা আপনার উসিলাতেই দূর হয়েছে এবং হবেও ইনশাআল্লাহ।
- আপনার উসিলাতেই হযরত আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হয়েছে;
- নূহ (আ.) এর নৌকা রক্ষা পেয়েছে;
- ইব্রাহীম (আ.) এর জন্য জ্বলন্ত আগুন পরিণত হয়েছে শান্তিময় বাগানে;
- সোলাইমান (আ.) ফিরে পেয়েছেন তাঁর রাজত্ব;
- আয়্যুব (আ.) মুক্তি পেয়েছেন দীর্ঘ রোগ-শোক থেকে;
- ইউনূস (আ.) রক্ষা পেয়েছেন গভীর সাগরের অতলে মাছের উদর থেকে;
আপনার উসিলাতেই ইসমাঈল (আ.) বেঁচে গেছেন জবেহের ছুরির আঘাত থেকে এবং হযরত আবদুল্লাহ (রা.) পেয়েছেন জীবনরক্ষা। আজও দুনিয়ায় যত রহমত বর্ষিত হচ্ছে, যত বালা-মুসিবত বিদূরিত হচ্ছে— তার মূলেই রয়েছে আপনার মহতী উসিলা।
দ্বিতীয়তঃ— ‘আজর’ শব্দের অন্য অর্থ সওয়াব এবং ‘মামনুন’ শব্দের অর্থ বন্ধ হওয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতটি বলছে— হে প্রিয়তম নবী (সাঃ)! আপনার সওয়াব কখনোই বন্ধ হবে না। আপনার উম্মত থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত, তারা নেক আমল করবে, তাদের আমল হবে বহুগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত, আর আপনি সওয়াব পেতে থাকবেন অবিরামভাবে।
তৃতীয়তঃ— আরেকটি দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, ‘আজর’ অর্থ সওয়াব, আর ‘মামনুন’ অর্থ অনুগ্রহ বা কৃতজ্ঞতা। এই অর্থে আয়াতের ব্যাখ্যা দাঁড়ায়— হে আমার হাবীব (সাঃ)! আপনার জন্য যে সওয়াব নির্ধারিত হয়েছে, তা কোনো বান্দার অনুগ্রহ নয়। কারণ, অন্য মানুষ তো তাদের জ্ঞান, রিযিক, ঈমান, সন্তান, ইজ্জত— সবই কোনো না কোনো উসিলায় পায় এবং কৃতজ্ঞ থাকে সেই উসিলার কাছে। কিন্তু আপনি— আপনি সেই একমাত্র মহান সত্তা যাঁর মাধ্যমে গোটা সৃষ্টিজগৎ প্রভুর দান ও রহমত লাভ করে। সবাই আপনার মুখাপেক্ষী, কিন্তু আপনি কেবল আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আপনার অনুগ্রহ সবার ওপর, অথচ আপনার ওপর কোনো বান্দার অনুগ্রহ নেই।
সুফি সাধকদের কেউ কেউ বলেছেন— আল্লাহ তাআলার নিজের সত্তাই হলেন হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আজর, সর্বোচ্চ পুরস্কার।
সারকথা হলো— যিনি সায়্যিদুল মুরসালিন, যাঁর মাধ্যমে বিশ্বজগত রহমত লাভ করেছে, তাঁর মর্যাদা, শান ও সম্মান নিয়ে কটু কথা বলা কেবল সেই জারজ ও হতভাগাদের কাজ— যাদের হৃদয়ে ঈমান নেই, যাদের মুখে লজ্জা নেই, আর যাদের অন্তরে কলঙ্ক ছাড়া কিছু নেই।